March 2, 2016

যে সব আমলের দ্বারা রিজিক বৃদ্ধি হয়

হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি অধিক পরিমাণে এসতেগফার পড়বে আল্লাহ তায়ালা তাকে সব দুশ্চিন্তা ও সঙ্কটাপন্ন অবস্থা থেকে মুক্ত করে দেবেন এবং তার ধারণাতীতভাবে তাকে জীবিকা দান করবেন।’ (আবু দাউদ)।

 জীবনের দিনগুলো নির্দিষ্ট। প্রতিটি ধাপের রয়েছে শেষ। প্রতিটি নিশ্বাস-প্রশ্বাসই আল্লাহ তায়ালার নিকট সংরক্ষত। সারা জীবন বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। স্থায়ীভাবে বসবাসের কোনো সুযোগ নেই। একমাত্র স্থায়িত্ব আল্লাহ তায়ালার। সৃষ্টির জন্য মৃত্যু অনিবার্য। তাই সবাইকে কাজ করে যেতে হবে। যার জন্য যা সৃষ্টি করা হয়েছে তা তার ভাগ্যে অবশ্যই জুটবে।
আচ্ছা মানুষের জীবিকা যদি মানুষের হাতে হতো তাহলে কেমন হতো? কত ব্যক্তিই না অত্যাচারের স্বীকার হতো। অসম বণ্টন আর হিংসা-বিদ্বেষের কবলে পড়ত। এটা মানুষের হাতে ছেড়ে দিলে একে অপরের ওপর কর্তৃত্ব করত। এমনকি একে অন্যকে ভুলে যেত। অবহেলা আর অবজ্ঞা করত।
অতএব পবিত্র সেই সত্তা যিনি কোনো অত্যাচার ও হিংসা ছাড়াই মানুষকে জীবিকা দান করেন। এক্ষত্রে তিনি কাউকে ভুলে যান না এবং কারও ক্ষত্রে অবহেলা পোষণ করেন না। বরং তিনি তাঁর অনুগ্রহে নেয়ামত দান করেন। তিনি দয়া করেন। তিনি দয়ালু এবং সর্বজ্ঞানী। তিনি এরশাদ করেন, ‘এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও, তোমরা কি অনুধাবন করবে না? আকাশে রয়েছে তোমাদের রিজিক ও প্রতিশ্রম্নত সবকিছু। নভোম-ল ও ভূম-লের পালনকর্তার কসম, তোমাদের কথাবার্তার মতোই এটা সত্য।’ (সূরা আজ জারিয়াত : ২১-২৩)।
জীবিকার চিন্তা মানুষকে গ্রাস করে ফেলেছে। ব্যসত্ম করে রেখেছে তাদের বিবেক-বুদ্ধি। কিছু মানুষ তো অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কথা শুনলেই ঘাবড়ে যায়। জীবনযাত্রার সমস্যা আর আর্থিক উত্থান-পতনে অস্থির হয়ে যায়। একথা যেন তাদের মনেই থাকে না যে, মানব ও জিন জাতিসহ সব সৃষ্টির জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা নিজেই গ্রহণ করেছেন। চাই তারা কাফের হোক বা মোমিন, দুর্বল হোক বা শক্তিশালী, ছোট হোক বা বড়। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আর পৃথিবীতে কোনো বিচরণশীল নেই, তবে সবার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছেন। তিনি জানেন, তারা কোথায় থাকে এবং কোথায় সমাপিত হয়। সবকিছু এক সুবিন্যসত্ম কিতাবে রয়েছে।’ (সূরা হুদ : ৬)। ‘এমন অনেক জন্তু আছে, যারা তাদের খাদ্য সঞ্চিত রাখে না। আল্লাহই রিজিক দেন তাদের এবং তোমাদেরও। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা আনকাবুত : ৬০)।
জীবিকার জন্য অযথা অস্থিরতা কাম্য নয়। সবাই তার বরাদ্দকৃত সময় ও জীবিকা শেষ করেই দুনিয়া থেকে বিদায় হবে। ইবনে আদম দুনিয়ায় আসার আগেই আল্লাহ তায়ালা তার জীবিকা লিখে রেখেছেন। ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকে তার মায়ের পেটে ৪০ দিন শুক্র হিসেবে থাকে। অতঃপর রক্তপি- হয়ে থাকে। অতঃপর মাংসপি-- রূপামত্মরিত হয়। এরপর তার কাছে ফেরেশতা পাঠানো হয়, সে তার মাঝে রুহ প্রবেশ করে আর তাকে চারটি বিষয় লিখে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়- জীবিকা, তার সময় বা বয়স এবং সে কি সৌভাগ্যবান না দুর্ভাগ্যবান।’ (বোখারি মুসলিম)।
কিছু আমল রয়েছে যা রিজিক বাড়ায়। জীবিকার ক্ষত্রে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এর শিক্ষা দিয়েছেন। শরিয়ত এসব আমলের ব্যাপারে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছে।
এসব আমলের মাঝে সর্বপ্রথম হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করা। যে আল্লাহকে ভয় করবে, তাকওয়াহ অর্জন করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে এমনভাবে রিজিক দান করবেন যে সে তা ভাবতেও পারবে না। আর আল্লাহ তায়ালার অঙ্গীকার সত্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য নিষ্কৃতির পথ করে দেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন।’ (সূরা তালাক :২-৩)।
এমনভাবে তাকে জীবিক দান করবেন যে, সে ধারণাও করতে পারবে না। যে জায়গার ব্যপারে তার আশা-প্রত্যাশাও ছিল না। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং পরহেজগারি অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানি ও পার্থিব নেয়ামতগুলো উন্মুক্ত করে দিতাম।’ (সূরা আরাফ : ৯৬)।
বান্দা তার পালনকর্তাকে ভয় করবে গোপনে এবং প্রকাশ্যে। ভয় করবে তার নিজের ক্ষত্রে, তার পরিবার-পরিজন, অর্থ-সম্পদ, কাজ-কর্ম ও তার সব কাজের ক্ষত্রে।
রিজিক বাড়ে এমন আমলের মধ্যে আরেকটি হচ্ছে অধিক পরিমাণে এসেত্মগফার পড়া এবং তা নিয়মিত করা। আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী নুহ (আ.) এর কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘অতঃপর বলেছি, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যমত্ম ক্ষমাশীল। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সমত্মান-সমত্মতি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্য উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্য নদীনালা প্রবাহিত করবেন।’ (সূরা নুহ : ১০-১২)। অন্যদিকে হুদ (আ.) এর কথা বলতে গিয়ে এরশাদ করেন, ‘আর হে আমার কওম! তোমাদের পালনকর্তার কাছে তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তারই প্রতি মনোনিবেশ করো; তিনি আসমান থেকে তোমাদের ওপর বৃষ্টিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির ওপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন, তোমরা কিন্তু অপরাধীদের মতো বিমুখ হইও না।’ (সূরা হুদ : ৫২)।
হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি অধিক পরিমাণে এসতেগফার পড়বে আল্লাহ তায়ালা তাকে সব দুশ্চিমত্মা ও সঙ্কটাপন্ন অবস্থা থেকে মুক্ত করে দেবেন এবং তার ধারণাতীতভাবে তাকে জীবিকা দান করবেন।’ (আবু দাউদ)।
কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘এতে বোঝা যায়, এসেত্মগফারে রিজিক বাড়ে এবং বৃষ্টি বর্ষিত হয়।’
জীবিকার প্রধান একটি বিষয় হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার ওপর যথাযথ ভরসা করা। হৃদয় মাওলার সঙ্গে যুক্ত থাকবে। সব ক্ষত্রে তার কাছেই সমর্পণ করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করবে সে তার সব প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট এবং তার সব অকল্যাণ ও ক্ষতিকর বিষয় তিনি প্রতিহত করবেন এবং ধারণাতীতভাবে তাকে জীবিকা দান করবেন। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যদি তোমরা আল্লাহ তায়ালার ওপর সঠিক ও যথাযথভাবে ভরসা করো, তাহলে তিনি তোমাদের পাখির মতো জীবিকা দান করবেন, ক্ষুধার্ত অবস্থায় সবাই বের হয় আর পেট পূর্তি করে বিকালে বাসায় ফিরে।’ (আহমাদ, তিরমিজি)।
ইবনে রজব (রহ.) বলেন, ‘তাওয়াক্কুল ও ভরসার ক্ষত্রে এই হাদিসটি মূলনীতি হিসেবে গৃহীত। আর তাওয়াক্কুল ও ভরসা জীবিকার বিভিন্ন আমল ও মাধ্যমের অন্যতম।’
পূর্বসূরিদের অনেকে বলতেন, ‘আল্লাহর ওপর ভরসা কর তাহলে কোন কষ্ট-ক্লেশ ছাড়াই তোমার রিজিকের ব্যবস্থা হবে।’
এক্ষত্রে একটি বিষয় ভালো করে জানা প্রয়োজন যে, মাধ্যম গ্রহণ করা বা কোনো কিছু পাওয়ার জন্য চেষ্টা করা তাওয়াক্কুল বা ভরসার পরিপন্থী নয়, বরং জ্ঞানী আলেম-ওলামারা বলেন যে, প্রচেষ্টা করা এবং মাধ্যম গ্রহণ করাই হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য। আর হৃদয় দিয়ে ভরসা করা তার প্রতি ঈমানের নামামত্মর।
আর মাধ্যম গ্রহণ করার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে সুগম করেছেন, অতএব তোমরা তার কাঁধে বিচরণ করো এবং তার দেয়া রিজিক আহার করো।’ (সূরা মুলক : ১৫)। ‘কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশে-বিদেশে যাবে।’ (সূরা মুজ্জাম্মিল : ২০)।
ওমর (রা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন জীবিকার সন্ধান না করে বসে বসে এই কথা না বলে, হে আল্লাহ আমাকে রিজিক দাও, কারণ তোমরা জান আকাশ কখনও স্বর্ণ-রুপা বর্ষণ করে না।’
বরকতময় জীবিকা পাওয়ার আরেকটি অন্যতম সূত্র হচ্ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যার জীবিকার প্রসারতা ও জীবনের ব্যাপ্তি তাকে আনন্দিত করে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে।’ (বোখারি)।
অতএব ভালোবাসার বীজ বুননে অপমৃত্যু থেকে বাঁচতে, দীর্ঘায়ু পেতে এবং প্রসারিত জীবিকা পেতে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার রয়েছে আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া এবং প্রত্যক্ষ ফলাফল।
আল্লাহ তায়ালার হেকমত ও অনুগ্রহের মধ্যে এটি একটি যে, তিনি দান-সদকা ও আল্লাহর পথে খরচ করার মধ্যেও অফুরমত্ম জীবিকার ব্যবস্থা রেখেছেন। তাই যে আল্লাহর রাসত্মায় খরচ করবে তিনি তার বিপরীতে তাকে দান করেন এবং তার কাছে যা আছে তাতে বরকত দান করেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘তোমরা যা কিছু ব্যয় কর, তিনি তার বিনিময় দেন। তিনি উত্তম রিজিকদাতা।’ (সূরা সাবা : ৩৯)।
দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালা এর পরিবর্তে কিছু দিয়ে এবং তাতে বরকত দিয়ে এর বিনিময় দান করেন। আর আখেরাতে উত্তম প্রতিদান ও বিশাল সওয়াবের মাধ্যমে বিনিময় দান করেন। কোরআনে এসেছে, ‘শয়তান তোমাদের অভাব-অনটনের ভীতি প্রদর্শন করে এবং অশস্নীলতার আদেশ দেয়। পক্ষামত্মরে আল্লাহ তোমাদের নিজের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও বেশি অনুগ্রহের ওয়াদা করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সুবিজ্ঞ।’ (সূরা বাকারাহ : ২৬৮)।
ইবনে আববাস (রা.) বলেন, ‘দুটি বিষয় আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর দুটি বিষয় শয়তানের পক্ষ থেকে। শয়তান অভাব-অনটনের ভয় দেখায়, আর বলে দান করো না, নিজের কাছে রেখে দাও। ভবিষ্যতে তোমার প্রয়োজন হবে। আর অশস্নীলতার আদেশ দেয়। অন্যদিকে আল্লাহ তায়ালা গোনাহ ও পাপের জন্য ক্ষমার ওয়াদা করেন এবং রিজিকে অনুগ্রহের অঙ্গীকার করেন।’
তাই বেশি করে দান করা চাই। এতে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশাল ও ব্যাপক বিনিময়ের সুসংবাদ রয়েছে। তিনি এরশাদ করেন, ‘বিত্তশালী ব্যক্তি তার বিত্ত অনুযায়ী ব্যয় করবে। যে ব্যক্তি সীমিত পরিমাণে রিজিকপ্রাপ্ত, সে আল্লাহ যা দিয়েছেন, তা থেকে ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যা দিয়েছেন, তদপেক্ষা বেশি ব্যয় করার আদেশ কাউকে করেন না। আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দেবেন।’ (সূরা তালাক : ৭)।
গরিব, অসহায় ও অভাবী মানুষের প্রতি সদয় ও তাদের খোঁজখবর নেয়ার জন্য আল্লাহ মানুষের রিজিক বাড়িয়ে দেন। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘তোমরা তোমাদের দুর্বলদের মাধ্যমে সাহায্যপ্রাপ্ত ও রিজিকপ্রাপ্ত হও।’ (বোখারি)।
বর্তমান সময়ে আমাদের প্রতিবেশী, কাছের মানুষ, ভাই-বন্ধুরা অনেকেই কঠিন ও দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে। তাদের খোঁজখবর নেয়া প্রয়োজন। তাদের প্রতি সদয় আচরণ করা এবং তাদের দান করা প্রয়োজন। আল্লাহ তায়ালা এর বিনিময় দান করবেন। রিজিকে বরকত দান করবেন, বরং এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তার সাহায্য-সহযোগিতা এবং সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা বাড়িয়ে দেবেন। #

মূল- শায়খ ড. ছালেহ বিন হুমাইদ, অনুবাদ- মহিউদ্দীন ফারুকী

0 comments:

Post a Comment

Popular Posts

Recent Posts

Categories

Unordered List

Text Widget

Powered by Blogger.

Formulir Kontak

Name

Email *

Message *

statistics

Recent

Comment

Subscribe

Facebook